তরিকুল ইসলাম, রংপুর
কারমাইকেল কলেজের সিএম হোস্টেলের ডাইনিং রুমের ঠিক পাশেই ছিল সেই সুবিশাল, ঐতিহাসিক বটগাছটা। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল – আমার কলেজজীবনের সোনালী অধ্যায়ের প্রতিটি দিনের সাক্ষী হয়ে আছে গাছটি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বটগাছের ছায়ায় বসেই চলত আমাদের আড্ডা। সেই সময়টা ছিল এক অদ্ভুত জাদুকরী।
তৎকালীন সিএম হোস্টেলটা যেন একটা জীবন্ত সত্তা ছিল। প্রাণোচ্ছল আর তারুণ্যের কলরবে মুখরিত থাকত প্রতিটি কোণ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হোস্টেলের করিডোরগুলো বন্ধুদের আনাগোনায় গমগম করত। ক্লাস শেষ করেই দ্রুত হোস্টেলে ফেরা, তারপর শুরু হতো আসল জীবন। বটগাছতলাটা ছিল আমাদের মিলনকেন্দ্র।
পরীক্ষার টেনশন থেকে মুক্তি পেতে, জীবনের গল্প বলতে, এমনকি সামান্য খুনসুটি করতেও আমরা ছুটে যেতাম ওই বটগাছের শীতল ছায়ায়। সেই বটগাছের ডালপালাগুলো সেদিন কতটা বিস্তৃত হয়েছিল, তা আজও আমার চোখে ভাসে। যেন আমাদের তারুণ্যের স্বপ্নগুলোও সেভাবেই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছিল প্রতিদিন।
হোস্টেলের ভেতরে ছিল অজস্র স্মৃতি। কমন রুমের ক্যারাম বোর্ড, টেলিভিশন দেখার জন্য বন্ধুদের ভিড়, পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়াশোনা, একে অপরের খাতাপত্র নিয়ে আলোচনা – সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে হোস্টেলের প্রতিটি ইঁট, প্রতিটি দেয়াল। বিশেষ করে ডাইনিং রুমের স্মৃতিগুলো তো ভোলার নয়। সাদামাটা খাবার, এক পোয়া ডালে কত লিটার যে পানি দেওয়া হতো! মনের আনন্দে ডাইনিং-এ বসে খেতাম আমরা। বন্ধুদের সাথে একসাথে বসে খাওয়াটাই ছিল বড় ব্যাপার। আর তারপরই তো সেই প্রিয় বটগাছতলায় আড্ডা। সে এক অন্যরকম শান্তি ছিল।
গ্রীষ্মের দুপুরে গাছের ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে যখন একফালি রোদ এসে পড়ত আমাদের আড্ডার আসরে, তখন মনে হতো যেন প্রকৃতির আশীর্বাদ নেমে এসেছে আমাদের ওপর।
সময়ের নিষ্ঠুরতা আর স্মৃতির অমলিন ছবি
সাতটি বছর কেটেছে এই হোস্টেলে। মাত্র ৭টি বছর, কিন্তু জীবনের এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে এর স্মৃতি। কত শত নতুন মুখ দেখেছি, কত শত নতুন বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, আবার কিছু বন্ধুত্ব সময়ের সাথে ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু হোস্টেলের সেই দিনগুলো, সেই উন্মুক্ত মন নিয়ে বেঁচে থাকা, সেই বটগাছ – সব যেন এক ঘোরের মতো মনে হয়।
আজও যখন দেখি হোস্টেলটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। যে হোস্টেল আমাদের তারুণ্যের আশ্রয় ছিল, হাসি-কান্না আর স্বপ্ন বোনার উর্বর ভূমি ছিল, সেটা আজ নীরব, নিষ্প্রাণ! যে করিডোরগুলোতে আমাদের পদধ্বনি মুখরিত ছিল, আজ সেখানে হয়তো ধুলোর আস্তরণ জমেছে। যে ডাইনিং রুমে হাসি-ঠাট্টা চলত, আজ হয়তো সেখানে শুধুই শূন্যতা। ভাবতেই কষ্ট হয়। সত্যিই সময়ের কী নির্মম পরিহাস!
তবুও, মনের গভীরে সেই বটগাছটা আজও সজীব। তার ছায়ায় বসে কাটানো সেই দিনগুলো আজও উজ্জ্বল। সময়ের চাকা ঘুরেছে, আমরাও জীবনের নানা বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছি। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক কেউবা এনজিও কর্মী – যে যে পেশাতেই থাকি না কেন, কারমাইকেল কলেজের সেই বটগাছ আর সিএম হোস্টেলের স্মৃতিগুলো চিরকাল অমলিন থাকবে। অসংখ্য স্মৃতিতে ভরা সেই দিনগুলো সত্যিই ভোলার নয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, যদি আর একবার সেই বটগাছতলায় ফিরে যেতে পারতাম, যদি আর একবার সেই পুরনো বন্ধুদের সাথে মন খুলে গল্প করতে পারতাম! হয়তো সময়ের স্রোত আমাদের অনেক দূর নিয়ে এসেছে, কিন্তু স্মৃতির ভেলায় চড়ে আমরা আজও সেই বটগাছতলায় ফিরে যাই, ফিরে যাই আমাদের সোনালী অতীতে।
https://slotbet.online/