তরিকুল ইসলাম, রংপুর
রংপুর কারমাইকেল কলেজের সুবিশাল সবুজ ক্যাম্পাসে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে এক অসাধারণ বৃক্ষ, যার নাম কাইজেলিয়া (Kigelia africana)। এটি কেবল একটি গাছ নয়, এটি যেন প্রকৃতির এক বিরল বিস্ময়। অনেকে এটিকে বাংলাদেশের একমাত্র কাইজেলিয়া গাছ বলে দাবি করলেও, কিছু সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে কারমাইকেল কলেজেই দুটি কাইজেলিয়া গাছ রয়েছে। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় হাতেগোনা যে কয়েকটি কাইজেলিয়া গাছ আছে, তার মধ্যে অন্যতম এই গাছ।
পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য:
কাইজেলিয়া গাছ ‘বিগনোনিয়াসিয়া’ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Kigelia africana, যা সাধারণত ‘সসেজ ট্রি’ বা ‘সসেজ গাছ’ নামেও পরিচিত, কারণ এর ফল দেখতে অনেকটা ঝুলন্ত সসেজের মতো।
* উচ্চতা: এই গাছ ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে, এমনকি ৩০-৩৫ মিটার পর্যন্তও দেখা যায়।
* ফুল: বসন্তকালে, সাধারণত ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে গাছে মেরুন বা কালচে লাল রঙের ফুল ফোটে। এই ফুলগুলো রাতের বেলায় ফোটে এবং এক রাতের মধ্যেই ঝরে যায়। ফুলের গন্ধ অনেকটা পচা মাংসের মতো, যা বাদুড়কে পরাগায়নে আকৃষ্ট করে।
* ফল: কাইজেলিয়ার ফলগুলো লম্বাটে ও গোলাকার, অনেকটা মোটা বেগুনের মতো। প্রতিটি ফলের ওজন ৫ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। কাঁচা অবস্থায় ফল সবুজ হলেও পাকলে বাদামি হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, ফলগুলো পাকার পরও এক বছর পর্যন্ত গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকতে পারে।
* পাতা: পাতাগুলো পক্ষল যৌগিক এবং গাঢ় সবুজ রঙের হয়।
ঔষধি গুণ ও ব্যবহার
কাইজেলিয়া গাছ তার অসাধারণ ঔষধি গুণের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। আফ্রিকার বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় শত শত বছর ধরে এই গাছকে নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করে আসছে।
* ত্বকের রোগ: এটি চর্মরোগ, সোরিয়াসিস, একজিমা এবং ফাঙ্গাসজনিত সমস্যায় অত্যন্ত কার্যকর। বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীতেও এর নির্যাস ব্যবহৃত হয়।
* ক্ষত নিরাময়: আলসার, সাপে কাটা এবং সিফিলিসের মতো রোগের ক্ষতে কাইজেলিয়ার ফল প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
* অন্যান্য ব্যবহার: বাত ব্যথা, এমনকি ক্যান্সারের চিকিৎসায় এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চলছে। যদিও কাঁচা ফল বিষাক্ত, তবে প্রক্রিয়াজাত করে এটিকে নিরাপদ করা হয়।
কারমাইকেল কলেজের কাইজেলিয়া
কারমাইকেল কলেজের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে এই বিরল গাছটি। কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নে, ১৯২০ সালের দিকে এই গাছটি এখানে রোপণ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এটি শুধু একটি উদ্ভিদ নয়, বরং এটি কারমাইকেল কলেজের ইতিহাসের একটি জীবন্ত অংশ এবং শিক্ষার্থীদের কাছে এক গবেষণার বিষয়। এর বিরলতা এবং ঔষধি গুণের কারণে এটি সবসময়ই দর্শনার্থী এবং প্রকৃতিপ্রেমীদের আকর্ষণ করে।
সংরক্ষণ ও ভবিষ্যৎ
কাইজেলিয়া গাছ সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে ভালো জন্মায়। যদিও এর সংরক্ষণ অবস্থা ‘Least Concern’ হিসেবে তালিকাভুক্ত, তবে অপরিকল্পিত ব্যবহার এবং বন উজাড়ের ফলে এর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। কারমাইকেল কলেজে এই বিরল গাছের উপস্থিতি এটিকে সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে। এই ধরনের গাছের যত্ন এবং চারা উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য স্থানেও এর বিস্তার ঘটানো সম্ভব, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
কাইজেলিয়া গাছ শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি আমাদের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের এক অনন্য উদাহরণ, যা ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।
https://slotbet.online/