‘সংসদ অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংবিধান স্থগিত না করেই যেভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম চলছে, তাতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন কমিশন ‘সাংবিধানিক সংকটে’ পড়বে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। এমন প্রেক্ষাপটে ‘বিপ্লবের উদ্দেশ্যসমূহকে এগিয়ে নিতে’ অসামরিক ফরমান জারি করে সংবিধান পুরোপুরি অথবা আংশিক স্থগিত করার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি একটি দৈনিক সংবাদপত্রে ‘সংস্কার-বিপ্লব ও ফরমান: সরকার ও সংবিধান’ শিরোনামে লেখা একটি কলামে তিনি এ আহ্বান জানান। ওই কলাম লেখার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, আলোচনার জন্য কাউকে তিনি পাচ্ছেন না। তাই নির্বাচন কমিশন যে ‘সাংবিধানিক সংকটে’ পড়েছে, সেটা পত্রিকায় লিখে জনগণকে অবহিত করাই সমীচীন বলে মনে করছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় তিন সপ্তাহ নিশ্চুপ থাকার পর হঠাৎ করেই সংবাদপত্রে কলাম লিখে নিজের মতামত জানিয়েছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। এর পর থেকেই তার বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে থেকেও পতিত স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে কাজ করা এবং সর্বশেষ অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে আইনি প্রশ্ন তোলায় তার পদত্যাগ ও বিচার দাবি করছেন অনেকে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর তার এ পদে বসে থাকার আর কোনো সুযোগ নেই।
দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পরদিনই সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এমন প্রেক্ষাপটে ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। তার আগে দেশের ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই বলে জানান সর্বোচ্চ আদালত। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি ছাড়াও সাংবিধানিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন প্রধান বিচারপতিও। পাশাপাশি তারা নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদেরও পদত্যাগের আহ্বান জানান। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে সরকারের সংকেতের অপেক্ষায় বসে আছেন সিইসিসহ অন্য নির্বাচন কমিশনাররা। সরকার পতনের পর এ ইস্যুতে তারা কোনো বক্তব্যও দিচ্ছেন না। এমন প্রেক্ষাপটে গত শনিবার (২৪ আগস্ট) একটি পত্রিকায় লেখা কলামের মাধ্যমে সিইসি নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন।
লেখায় তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের পতন হয়েছে। বিপ্লবটি ছিল তারুণ্যের শক্তিতে উদ্দীপ্ত ব্যাপক জনসম্পৃক্ত অনন্যসাধারণ এক অসাধ্য সাধন। অসংখ্য নিরীহ শিশু-কিশোর, তরুণ ও বৃদ্ধকে জীবন দিতে হয়েছে। তবে বিশেষ একটি কারণে বিপ্লবোত্তর এই সময়ে খানিকটা সাংবিধানিক শূন্যতা দৃশ্যমান। সংবিধান কতটুকু বা কীভাবে বলবৎ আছে, বোধগম্য হচ্ছে না। স্পষ্টতা প্রয়োজন। অস্পষ্টতা অনাকাঙ্ক্ষিত। ভবিষ্যতে আইনগত জটিলতা হতে পারে।’
সাবেক আমলা হাবিবুল আউয়াল নিজের যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে ৫৩ বছরে বাংলাদেশে আন্দোলন-অভ্যুত্থান-বিপ্লবের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ওর থেকেও বড় কিছু ছিল। দেশ স্বাধীন হলো। অনেক প্রত্যাশা ছিল। ৭২-এ সংবিধান হলো। ৭৩-এ নির্বাচন হলো। বিতর্কিত নির্বাচন। ৭৪-এ বাকশাল হলো। সেটাও অন্তরালে বিতর্কিত ছিল। শেখ মুজিবের দ্বিতীয় বিপ্লব। বাকশালে যোগদান করতে বিশিষ্টদের লাইনের পর লাইন। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে এক সামরিক বিপ্লবে হত্যা করা হলো। নভেম্বরে আবারও সামরিক বিপ্লব এবং পরে অচিরেই সৈনিক-জনতার অংশগ্রহণে এক সফল প্রতিবিপ্লব।
৯০-তে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনতার সফল বিপ্লব, ৯৬-তে আবারও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য জনতার মঞ্চ নামক সফল বিপ্লবে খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলেন। ভালো নির্বাচন হলো।
২০০১-এ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলো। ২০০৭-এ আবারও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে লগি-বৈঠার বিপ্লব হলো। তথাকথিত সেনাসমর্থিত অসাংবিধানিক সরকার দুবছর ক্ষমতায় থেকে তেমন কিছু স্থায়ী সমাধান জাতিকে দিতে পারল না।’
কলামে ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি। শুধু তাই নয়, তার অধীনে এ বছর ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত স্থায়ী সফলতা জনগণ দেখতে চায়।’ যদিও এর আগে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মুখে আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একতরফা জাতীয় নির্বাচনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘এ নির্বাচনে সরকারের সহায়তা ছিল, আন্তরিকতা ছিল। তাই সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।’
অভ্যুত্থান বা বিপ্লব-পরবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংবিধান আংশিক বা পুরোপুরি স্থগিত করা কেন জরুরি, তার পক্ষে নিজের যুক্তিগুলো তুলে ধরে এক সময় আইন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করা হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘সামরিক অভ্যুত্থান হলে সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানকে অবিলম্বে রহিত বা স্থগিত করা হয়। স্থগিত করা হলে ফরমানকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে অগ্রগণ্যতা দেওয়া হয়। অর্থাৎ, ফরমান ও স্থগিত সংবিধানের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে ফরমানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আইনের শাসনের ধারাবাহিকতাকে এভাবে বজায় রাখা হয়। বিপ্লবী সরকার শপথ নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে আগাম বৈধতা নেওয়া হয়েছে। পরে আপিল বিভাগকেই বিদায় করা হয়েছে। আমার সোজাসাপটা কথা হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থান কার্যকর করতে আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না। গণঅভ্যুত্থান একটি স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা। আইনের ঊর্ধ্বে এর অবস্থান। তবে বিপ্লব-উত্তর সময়ে আইনের ঊর্ধ্বে একটি ফরমান অনিবার্যভাবে প্রয়োজন। সামরিক আমলারা তা জানেন। সুশীল আমলারা সেটা বোধকরি জানেন না।’
সিইসি আরও লিখেছেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতন হলে ইতোপূর্বে বহাল থাকা সরকারকে অপসারণ করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হলে সংবিধান অকার্যকর হয়ে যায়। উদ্ভূত এমন পরিস্থিতিতে অবিলম্বে একটি অসামরিক ফরমান জারি করে প্রচলিত সংবিধানকে বাতিল করে, বা স্থগিত রেখে, বা পাশাপাশি বহাল রেখে, অসামরিক ফরমানকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান প্রদান করা হলে সাংবিধানিক বা আইনগত সংকট পরিহার করা যেতে পারে। এটি বহুল অনুসৃত পদ্ধতি।’
এ প্রসঙ্গে কাজী হাবিবুল আউয়াল তার কলামে সমসাময়িক বিশ্বের উদাহরণও টেনেছেন।
সংসদ অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি নির্বাচন কমিশনের সামনে সংকটের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন হয়তো অচিরেই বিগত হবে। কিন্তু এতে সংকটের নিরসন হবে না। সংসদ অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে ভেঙে দিতে হয়েছে। সফল বিপ্লবের (বাস্তবানুগ) গ্রামারে এটি অবশ্যই সিদ্ধ। সংবিধান যদি বহাল থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদের বিধানমতে তৎপরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। যদি না করেন, তাহলে সেক্ষেত্রে ৭খ অনুচ্ছেদের বিধানমতে কমিশনারগণ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ করে থাকবেন। সংবিধানকে পুরোপুরি অক্ষুণ্ন রেখে বিপ্লবকে তথা বিপ্লবের উদ্দেশ্যসমূহকে এগিয়ে নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা যায় না।’
সংবাদপত্রে তুলে ধরা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর দেশের চরম এক ক্রান্তিলগ্নে সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ পড়িয়েছেন, যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের মতো রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে সিইসির এমন বক্তব্য মোটেও সমীচীন হয়নি।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘সিইসি সংবিধান স্থগিত করতে বলেছেন এবং ফরমান জারি করতে বলেছেন; কিন্তু সংবিধানে এ দুটির কোনোটিরই বিধান নেই। তাহলে কীভাবে তিনি এমন বক্তব্য দিলেন। তার এসব বক্তব্য সরকারকে বিপদে ফেলতে পারে।’
https://slotbet.online/