সম্পাদকীয়
চেতনার বাতিঘর ও আমাদের দায়বদ্ধতা
সোহেল সরকার
প্রকাশক ও সম্পাদক, দৈনিক প্রতিবাদ, লন্ডন
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস, কিন্তু এই বিজয়ের আনন্দাশ্রুর সাথে মিশে আছে এক গভীর শোকের ছায়া। ১৪ই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর আল-বদর, আল-শামসরা মেতে উঠেছিল এক জঘন্য হত্যাযজ্ঞে। বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে তারা বুঝতে পেরেছিল তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তাই বাঙালি জাতিকে মেধা ও মননে পঙ্গু করে দেওয়ার হীন উদ্দেশ্যে তারা বেছে বেছে হত্যা করেছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের—আমাদের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, লেখক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের।
আজ সুদূর প্রবাসে, এই লন্ডনের মাটিতে বসে যখন দেশের কথা ভাবি, তখন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। আমরা যারা বিলেতে বসবাস করছি, আমাদের অনেকেরই হয়তো একাত্তরের সেই ভয়াবহ স্মৃতি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি, কিংবা অনেকে শিশু ছিলাম। কিন্তু ইতিহাসের সেই নির্মম অধ্যায় আমাদের ধমনীতে আজও শিহরণ জাগায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা কেবল একেকটি নাম নন, তাঁরা ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, মুক্তচিন্তার পথপ্রদর্শক।
শহীদ মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সেলিনা পারভীন, ডা. আলিম চৌধুরীসহ নাম না জানা অসংখ্য বুদ্ধিজীবী সেদিন নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের জন্য একটি স্বাধীন মানচিত্র এঁকে দিয়ে গেছেন। তাঁদের অপরাধ ছিল—তাঁরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলতেন, তাঁরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন এবং একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক প্রতিবাদ’-এর পক্ষ থেকে আজ আমরা সেই সকল সূর্যসন্তানদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। তবে কেবল স্মরণ করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। প্রবাসে বেড়ে ওঠা আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাসের সঠিক পাঠ পৌঁছে দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের সন্তানদের জানাতে হবে—কেন একটি জাতিকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল? কাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা বিশ্বের বুকে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচয় দিতে পারি?
বুদ্ধিজীবীরা যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়নে আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রবাসে থেকেও আমরা দেশের সেই স্বপ্ন পূরণে ভূমিকা রাখতে পারি। আমাদের কলম, আমাদের কণ্ঠস্বর এবং আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস হোক সেই হাতিয়ার।
আজকের এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক—শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শকে ধারণ করে আমরা এগিয়ে যাব। ঘাতকরা দেহ কেড়ে নিতে পেরেছে, কিন্তু চেতনাকে ধ্বংস করতে পারেনি। সেই চেতনা আমাদের বাতিঘর হয়ে জ্বলুক অনন্তকাল।
বিনম্র শ্রদ্ধা সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীর প্রতি।
সোহেল সরকার
প্রকাশক ও সম্পাদক দৈনিক প্রতিবাদ
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।
https://slotbet.online/