নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর
চিকিৎসা পেশা একটি মহৎ সেবা, কিন্তু বর্তমান সময়ে এর বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রায়শই দেখা যায়, চিকিৎসকের চেম্বারে গেলেই রোগ নির্ণয়ের জন্য একগাদা অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দেওয়া হয়। এরপর সেই টেস্টের ফলাফল অনুযায়ী প্রেসক্রিপশনে লেখা হয় একগাদা দামি ওষুধ। রোগী ধনী হোক বা গরীব, এই প্রবণতার শিকার হন সবাই। এতে একদিকে যেমন রোগীর আর্থিক চাপ বাড়ে, তেমনি অন্যদিকে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমতে থাকে।
চিকিৎসকদের এই ধরণের আচরণ কয়েকটি কারণে ঘটে থাকে। প্রধান কারণগুলো হলো:
১. ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির প্রভাব: ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বিক্রির জন্য চিকিৎসকদের নানা ধরনের উপটৌকন, বিদেশ ভ্রমণ, এবং আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে। এর বিনিময়ে চিকিৎসকরা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে থাকেন।
২. ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশন: বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসকদের মোটা অঙ্কের কমিশন দেয় রোগীর কাছ থেকে টেস্ট করানোর জন্য। যত বেশি টেস্ট, তত বেশি কমিশন।
৩. প্রতিরক্ষামূলক ঔষধ অনুশীলন (Defensive Medicine): কিছু চিকিৎসক আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চান, যাতে কোনো ভুলত্রুটি না হয়। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এসব পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন থাকে না।
৪. ব্যবসায়িক মানসিকতা: বর্তমান যুগে অনেক চিকিৎসক চিকিৎসা সেবাকে একটি ব্যবসায়িক পেশা হিসেবে দেখছেন। তাদের কাছে রোগীর সুস্থতার চেয়ে আর্থিক লাভ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অপ্রয়োজনীয় টেস্ট এবং ওষুধের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ ও দরিদ্র রোগীরা। সামান্য সর্দি-কাশির জন্যও এমন সব টেস্ট দেওয়া হয়, যার খরচ বহন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক সময় ধারদেনা করে টেস্ট করালেও চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনার টাকা থাকে না। এর ফলস্বরূপ, রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন, তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং পরিবারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়।
এই সমস্যা সমাধানে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:
নৈতিকতার অনুশীলন: চিকিৎসকদের পেশাগত নীতিশাস্ত্র মেনে চলতে হবে। শুধু রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ীই টেস্ট এবং ওষুধ লিখতে হবে।
মনিটরিং ব্যবস্থা: সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যেসব চিকিৎসক এই ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। কোনো চিকিৎসক যদি অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দেন বলে মনে হয়, তবে দ্বিতীয় কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও টেস্টের খরচ এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সরাসরি চিকিৎসককে প্রশ্ন করা যেতে পারে।
চিকিৎসক এবং ওষুধ কোম্পানির মধ্যে স্বচ্ছতা: চিকিৎসক এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক আরো স্বচ্ছ করতে হবে। এই বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট আইন থাকা দরকার, যেখানে অনৈতিক উপটৌকনের আদান-প্রদান নিষিদ্ধ থাকবে।
চিকিৎসা ব্যবস্থা মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ব্যবস্থার ওপর থেকে মানুষের আস্থা হারানো সমাজের জন্য একটি অশনি সংকেত। চিকিৎসকদের উচিত, মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ব্যবসা না করে, তাদের সেবার ব্রতকে প্রাধান্য দেওয়া। মনে রাখতে হবে, মানুষের সুস্থতাই একজন চিকিৎসকের প্রকৃত অর্জন, আর এই অর্জন টাকা দিয়ে কেনা যায় না।
https://slotbet.online/