নিজস্ব প্রতিবেদক:-শিকার হয়েছেন একজন। এতে অন্যায়, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে, যেখানে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক মানবতার পক্ষে শক্তি হিসেবে কাজ করেন। তারা সামাজিক অবক্ষয় এবং রাষ্ট্রীয় শোষণ-নিপীড়নের সঠিক চিত্র তুলে ধরেন। ফলে সাংবাদিকরা আজ পড়েছেন বিপাকে। কখনও কখনও সাংবাদিক নিজেরাই সংবাদের শিরোনাম হয়ে যাচ্ছেন। এটি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গণমাধ্যম।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আজ রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ও পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করা যেন “জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ” পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক নয়, কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণও হয়ে উঠেছে সাংবাদিকতার বড় বাধা। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান বা মালিকপক্ষের স্বার্থে খবর বিকৃত করা, কিছু তথ্য এড়িয়ে যাওয়া বা পুরো রিপোর্ট নিবিড়ভাবে সংশোধন করা আজ নতুন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এর ফলে সাংবাদিকতা এখন আর সমাজের দর্পণ নয়, হয়ে উঠছে কর্পোরেটের মুখপাত্র।
যদিও বাধা, ভয়, হুমকি, দমন সবকিছু সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো কিছু অনুসন্ধানী সাংবাদিক তাদের দায়বদ্ধতা থেকে সরে আসেননি। তারা ঝুঁকি নিয়েই তুলে আনছেন দুর্নীতি, নিপীড়ন, অবিচার কিংবা অনিয়মের খবর। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্বাধীন অনলাইন পোর্টালগুলো হয়ে উঠছে বিকল্প কণ্ঠস্বরের মাধ্যম। তবে সেখানেও চোখ রাঙানো সেন্সরশিপ অপেক্ষা করে। বিশেষ করে অনুসন্ধানী ও ডেটা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে চরম ঝুঁকি ও আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় আইন, রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক চাপ এবং প্রভাবশালীদের রোষানল সব মিলিয়ে সাংবাদিকদের কাজ যেন প্রতিনিয়ত স্রোতের বিপরীতে চলার মতো। বর্তমানে বাংলাদেশে সাংবাদিক ও সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণে কমপক্ষে ২০টির বেশি আইন রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: আদালত অবমাননা আইন, ১৯২৬; বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪; প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩); বাংলাদেশ দণ্ডবিধি; ফৌজদারি কার্যবিধি; কপিরাইট আইন; অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩; তথ্য অধিকার আইন, ২০১১; নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন; শ্রম আইন; ভোক্তা অধিকার আইনসহ আরও অনেক আইন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এসব আইনের বেশিরভাগই সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় নয়, বরং দমন ও নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর বিপরীতে সাংবাদিকদের সুরক্ষা বিধানের জন্য কার্যকর কোনো আইন নেই। আইনগত কাঠামোতে সবচেয়ে বেশি ভয়ভীতির উৎস হচ্ছে আদালত অবমাননা আইন ও মানহানি আইন। আদালত অবমাননার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই; বিচারকের বিবেচনাতেই নির্ধারিত হয় কোন মন্তব্য অবমাননাকর হবে। অন্যদিকে, মানহানি আইন ফৌজদারি ও দেওয়ানি দুইভাবেই প্রযোজ্য। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্বরা সাংবাদিকদের দমনে এই আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদ লিপি পাঠানোর আগেই মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তারের নজির রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, বেশিরভাগ আইনই উনিশ শতক কিংবা পাকিস্তান আমলের। এসব আইন আধুনিক সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও গতিশীলতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তবু এগুলো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হচ্ছে। উপরন্তু, সাংবাদিকদের হয়রানি করতে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা মিথ্যা মামলা যেমন: জুলাই গণহত্যা, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদিতেও জড়িয়ে ফেলছেন। যার ফলে সাংবাদিকতা এখন হুমকীতে পড়েছে। এ পেশায় ঢুকে পড়েছে এক শ্রেণীর অশিক্ষিত পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ।
দেশের অধিকাংশ সাংবাদিক সংগঠনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, প্রতিটি সংগঠনের প্রভাবশালীরা রয়েছেন কোনো না কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের। অনেক জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। তাহলে আপনারা বলুন, কীভাবে দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে? আর দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠিত না হলে কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা কম নয়, সাংবাদিকের সংখ্যাও বিপুল, সংগঠনও রয়েছে বহু। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সাংবাদিক সমাজে বিভাজন প্রকট, যা আমাদের সবচেয়ে দুর্বল করে তুলেছে। পেশাগত দাবি আদায়, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ কিংবা আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গড়ে তুলতে না পারার কারণে সাংবাদিক নিগ্রহের হার বাড়ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আশঙ্কা করা যায়—সাংবাদিকদের ওপর চাপ আরও বাড়বে, বাক-স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হবে। প্রশাসন, রাজনীতি ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে আরও বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইনের অপব্যবহার হতে পারে।
সকলেই জানে, সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়; এটি একটি দায়িত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সেবা। তাই সাংবাদিকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার রক্ষায় সাংবাদিক সমাজ, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক হয়রানি, গ্রেপ্তার ও মামলা শুধু ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, এটি সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে যদি আমরা একে অপরকে একা রেখে দিই, তাহলে একদিন আমরা কেউ-ই সত্য প্রকাশের সাহস করবো না।
সাংবাদিকতা যদি হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, তবে সেই স্তম্ভ আজ দুর্বল, চিড়ধরা, আর কখনও কখনও জব্দ। সত্যকে বন্দি রাখার জন্য যত রকম অস্ত্র ব্যবহৃত হয়—হুমকি, হয়রানি, মামলা, নিয়ন্ত্রণ—তা আজ নিত্য বাস্তবতা। তবু প্রতিদিন কেউ না কেউ সাহস করে প্রশ্ন তোলে। কারণ এখনো কিছু মানুষ আছেন, যারা বিশ্বাস করেন: সত্য বলার চেয়ে বড় দায়িত্ব, আর কোনো পেশায় নেই।
লেখক:
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি, ঢাকা প্রেস ক্লাব
লেখক ও গবেষক
https://slotbet.online/